নিজস্ব সংবাদদাতা:চিরাচরিত ঐতিহ্য বহন করেই আজও মণিপুরী ঘরানার লোকসংস্কৃতি ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই দোল উৎসব পালিত হয় নবদ্বীপের “অনুমহাপ্রভু” মন্দির, তথা মণিপুর পুরাতন রাজবাড়ীতে।
শ্রী চৈতন্য দেবের জন্মভূমি নবদ্বীপ শহর হওয়ায় শহর জুড়ে রয়েছে তার স্মৃতি বিজারিত বহু স্থান ও মন্দির। তবে শহরের দক্ষিনাঞ্চলে রয়েছে গৌড়াঙ্গ মহাপ্রভুর এক ব্যাতিক্রমি মন্দির, আর এই মন্দিরকে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য ইতিহাস,। শহরের মণিপুর এলাকায় রয়েছে এই মন্দির, যাকে সকলে অনুমহাপ্রভুর মন্দির বা পুরাতন রাজবাড়ী বলে চেনে। এখানে গৌড়াঙ্গ মহাপ্রভুর মূর্তীতেও রয়েছে ব্যাতিক্রমি,।
ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে জানা যায় এই মন্দিরে পুজিত অনু মহাপ্রভুর এই প্রাচীন মূর্তিটি ১৭৯৮ খ্রিষ্টাব্দে রাজর্ষী ভাগ্য চন্দ্র মহারাজ নবদ্বীপে নিয়ে আসেন। রাজর্ষী ভাগ্যচন্দ্র মহারাজের এর বর্তমান বংশধর তথা এই মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক রাজকুমার তিকেন্দ্র জীৎ সিং জানান এই মন্দিরের যেমন একটা ইতিহাস আছে পাশাপাশি আমাদের এই মন্দিরের যে সকল ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান হয়ে থাকে তারও একটা ঐতিহ্য আছে, তিনি বলেন ১৭৯৮ খ্রিষ্টাব্দে মনিপুরের মহারাজ রাজর্ষী ভাগ্যচন্দ্র মহারাজ স্বপ্নাদেশ পেয়ে কাঁঠাল কাঠ দিয়ে নির্মিত অপরূপ এই অনুমহাপ্রভুর মূর্তিটি নবদ্বীপে নিয়ে আসেন, যে মূর্তীতে মণিপুরী শৈলীর প্রভাব সুস্পষ্ট দেখা যায়।
তবে তার আগেই এই এলাকায় জমি কিনে রেখে যান তিনি, এবং ১৭৯৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এখানে বসবাস করেন রাজর্ষী ভাগ্যচন্দ্র মহারাজ। রাজকুমার তিকেন্দ্র জীৎ সিং আরও জানান বর্তমানে তারা মোট ছয় সরিক এখানে বসবাস করেন, বর্তমানে এখানে প্রায় একশো মণিপুরী সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস বলেও তিনি জানান। তিনি আরও জানান ১৭৯৮ খ্রিষ্টাব্দে অনুমহাপ্রভুর মূর্তী নবদ্বীপে আসলেও এই মন্দির নির্মান হয় ১৮০৫ খ্রিষ্টাব্দে,ভাগ্যচন্দ্র মহারাজের বড় ছেলে চৌরজিৎ সিংহ এর সময়কালে।সেই সময় একটি সমতল ছাদের মন্দির তৈরি করা হয়।আর সেই সম থেকেই এই মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের,। তবে উল্লেখ যোগ্য ভাবে দোল উৎসবে থাকে বেশ কিছু ব্যাতিক্রমি অনুষ্ঠান ও নিয়মও, যেমন দোল উৎসবের আগের দিন সব জায়গায় ন্যাড়াপোড়া হলেও এখানে দোল পূর্ণিমার দিন অনুষ্ঠিত হয়।
এরই সাথে দোল উৎসবের কদিন এখানে অনুষ্ঠিত হয় মণিপুরী ঘরানার বিভিন্ন লোকসংস্কৃতি ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, পাশাপাশি এই দোল উৎসবকে কেন্দ্র করে সুদুর মণিপুর রাজ্য থেকেও সমাগম ঘটে হাজার হাজার ভক্তরও।এবছর মহাপ্রভুর ৫৪০ তম শুভ আবির্ভাব তিথি উপলক্ষে ১০ই মার্চ থেকে শুরু হয়েছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের যা চলবে আগামী ১৫ই মার্চ পর্যন্ত। সকাল থেকেই শুরু হ’য়েছে ভক্তদের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের। পাশাপাশি জানা যায় অনুমহাপ্রভুর শ্রীবিগ্রহ ছাড়াও এই মন্দিরে আছে রাধাকৃষ্ণের মূর্তী, প্রভু জগন্নাথ দেবেরও মূর্তী,আর এই মন্দিরে প্রতিদিন দু বেলা হয় অন্নভোগ দেওয়া হয় বলেও জানা যায়। তবে মণিপুরী হওয়া সত্বেও কেন হঠাৎ মহাপ্রভুর প্রতি তাদের এই টান বা ভক্তি,? উত্তরে রাজকুমার বলেন এটা ভাগ্যচন্দ্র মহারাজের আমলেরও কয়েকশো বছরে পূর্ব থেকে হয়ে আসছে, তিনি জানান বহু অতীত কালে আমাদের(মণিপুরীদের) যে ধর্মটা ছিলো রামানুজ, পরবর্তী সময়ে বিষ্ণুদেব, শৈব্য ধর্মেরও প্রচলন ছিলো পরবর্তী সময়ে সময়ের সাথে পরিবর্তন হয়, ও গৌড় ধর্মে বা মহাপ্রভুর টানে আমরা এখানে চলে আশি। দোল উৎসবকে কেন্দ্র করে একাধারে যেমন নবদ্বীপে সমাগম ঘটেছে বহু ভক্ত ও পর্যটকদের, পাশাপাশি এই উৎসবকে ঘিরে মনিপুর রাজবাড়ীতে বসবাস কারি বাসিন্দারা ছাড়াও মনিপুর রাজ্য থেকে বহু মানুষ এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এখানে উপস্থিত হয়েছেন।
মণিপুররাজ ভাগ্যচন্দ্রের কন্যা বিম্বাবতী দেবীর সেবিত অনুমহাপ্রভুর শ্রী বিগ্রহ দর্শন করতে ও মণিপুরী ঘরানার বিভিন্ন লোকসংস্কৃতি অনুষ্ঠান দেখতে প্রতিদিন নবদ্বীপ শহরের পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী বহু এলাকার মানুষের সমাগম ঘটে দোল উৎসবের কদিন, কারন একাধারে যেমন মণিপুরী ঘরানার এই ধরনের ভক্তিমূলক ও লোকসংস্কৃতির অনুষ্ঠান সচরাচর দেখা মেলে না, আর এই দোল উৎসবকে ঘিরে এই মন্দির যেন এখন এক টুকরো মণিপুর রাজ্যে পরিনতি হয়েছে, তবে এখানে নেই কোন রাজনৈতিক অস্থিরতা পরিস্থিতি, এখানে শুধুই আছে মণিপুরী ভক্তদের নিজেদের ভাষায় গৌড়াঙ্গ মহাপ্রভুর তথা হরিনাম সংকির্ত্তনের আওয়াজ, আর “জয় অনুমহাপ্রভুর জয়” ধ্বনি।
