মুখের ভাষা যে তাঁদের রুটিরুজি কেড়ে নেবে তা কোনদিন কল্পনাও করতে পারেননি তুফানগঞ্জের অতুল, সুমন, মফিজুলরা। বিয়ের পর হরিয়ানাতে স্বামী-স্ত্রীতে উপার্জনে বেশ চলছিল তাঁদের সংসার। শুধুমাত্র বাংলা ভাষা বলায় তাঁদের জীবনে নেমে এলো কালো মেঘের ছায়া। আতঙ্কে হরিয়ানা ছাড়লেন তুফানগঞ্জের প্রায় দেড়শো জন পরিযায়ী শ্রমিক। নিজেরাই বাসভাড়া করে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তুফানগঞ্জে ফেরেন পরিযায়ী শ্রমিকরা।
অধিকাংশ শ্রমিক সপরিবার সেখানে ৮-১০ বছর ধরে কাজ করতেন। তাঁদের অভিযোগ, বাংলা ভাষায় কথা বললেই বাংলাদেশি সন্দেহে ধরে নিয়ে যেত পুলিশ। থানা থেকে ছাড়া পেতেও মোটা টাকা দিতে হতো পুলিসকে। প্রাণ বাঁচাতে কাজ ছেড়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা। তাঁদের কঠিন অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরছেন অনেকে ৷ তবে তা সত্ত্বেও তাঁরা পেটের টানে আবারও ফিরতে চান পুরনো কর্মক্ষেত্রে।

এদিকে, এনআরসির নোটিস আসতেই সেই বাড়িতে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় তৃণমূল নেতাদের মধ্যে। অথচ কর্মহারিয়ে ভিনরাজ্য থেকে শ্রমিকরা বাড়িতে ফিরলেও সেখানে পা পড়ছে না তৃণমূল নেতাদের। যা নিয়ে তৃণমূলকে তোপ দেগেছে বিজেপি।
তুফানগঞ্জ থানার অন্তর্গত নাককাটি গাছ, বালাভূত, দেওচড়াই গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তত দুশো পরিবার এক দশকেরও বেশি সময় ধরে হরিয়ানার গুরুগ্রামে থাকছেন। সেখানে টিনের ঝুপড়ি বানিয়ে পরিযায়ী শ্রমিকের হিসেবে কাজ করছেন পরিবারের সদস্যরা। মহিলারা কেউ গৃহ পরিচারিকা, কেউ রান্নার কাজ করেন। পুরুষরা কেউ নির্মাণ শ্রমিক, কেউ অন্য কাজে বা অন্য পেশায়। বাংলা ও বাঙালি নিয়ে সরগরম রাজ্য। বিজেপি শাসিত রাজ্যে বারবার বাঙালি শ্রমিকদের হেনস্তার অভিযোগে তোলপাড়।
অভিযোগ, যখন- তখন হানা দিয়ে পুলিশ তাঁদের উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশী সন্দেহে। তারপর চলছে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। পুলিশি ধরপাকড় ও অত্যাচারের আতঙ্কে ঘরে ফিরছেন তুফানগঞ্জের শ্রমিকরা। তিন দিন পর হরিয়ানার গুরুগ্রাম থেকে বাসভাড়া করে শ্রমিকরা নিজের গ্রামে ফিরলেন। তাঁদের চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ। কাজ হারানোর যন্ত্রণা। হতাশার অন্ধকার। যেন স্বদেশেই সকলে শরণার্থী।
কিন্তু ঘরে ফিরে এখন করবেন কি? চাই প্রতি পেটে ভাত। প্রতি হাতে কাজ। ঘরফেরা শ্রমিকরাই বলছেন, বাংলায় কাজ নেই। কাজ মিললেও ভালো মজুরি মেলে না। সেই কারণেই তো গা- গঞ্জ থেকে প্রচুর মানুষ ভিড় জমিয়েছিলেন ভিন রাজ্যে। কিন্তু বাঙালি মাত্রেই বাংলাদেশি সন্দেহে পুলিশি হয়রানির হাত থেকে বাঁচতে, ঘটিবাটি, আসবাব ছেড়ে শুধু এক কাপড়ে তড়িঘড়ি যে যেমন পারছেন দলে দলে ফিরে আসছেন। যেন অঘোষিত, ইমারজেন্সি।কিন্তু প্রশ্ন হল, এবার ঘরে ফিরে আসা শ্রমিকরা কী করবেন? কীভাবে তাঁদের অন্ন সংস্থান হবে? তাঁরা বলছেন, পরিস্থিতির একটু উন্নতি হলেই তাঁরা ফের পাড়ি দেবেন ভিনরাজ্যে। গ্রামে থাকলে না-খেয়েই তাঁদের মরতে হবে।