শরতের সোনালি আলো আর পাহাড়ের ঠান্ডা বাতাসে এবার দার্জিলিংয়ের আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে উৎসবের হাওয়া। শহরজুড়ে কাশফুলের সোনালি রঙ আর সাদা মেঘের খেলা মিলিয়ে এক অন্যরকম দুর্গোৎসবের ছোঁয়া। কিন্তু তবুও নজর কেড়ে নেয় নৃপেন্দ্র নারায়ণ হিন্দু হলে দুর্গাপুজোর ঐতিহ্য। দশমীর দিনে মা দুর্গার প্রতিমা কাঁধে করে শহর প্রদক্ষিণ, আর ট্রয় ট্রেনে তুলে নেওয়া হবে বিসর্জনের জন্য—যা দীর্ঘ এক দশক পর আবার ফিরে এল।
নৃপেন্দ্র নারায়ণ হিন্দু হলের পুজো ১৯৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত। শতাব্দী পেরিয়েও এই পুজো শুধু ধর্মীয় আয়োজন নয়, বরং পাহাড়ের সংস্কৃতির এক অমূল্য অংশ। স্বাধীনতার আগে এই মঞ্চে ভাষণ দিয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ, সিস্টার নিবেদিতা এবং চিত্তরঞ্জন দাশ। শিলিগুড়ি থেকে টয় ট্রেনে চেপে মায়ের প্রতিমা আসে এই হলে—এই স্মৃতি এখনও পাহাড়ের মানুষের মুখে মুখে জীবিত। শারদোৎসবের দিন হল প্রাঙ্গণ হয়ে ওঠে রঙিন উৎসবের আসর। শঙ্খধ্বনি, ঢাকের তালে ধুনুচি নাচের আনন্দ, পাহাড়ি সংস্কৃতির আচার—সব মিলিয়ে এক মিলনমেলা।

সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী—প্রত্যেক দিনই জমকালো অনুষ্ঠান। বিশেষভাবে আমন্ত্রিত ব্রাহ্মণরা ভোগ রান্না করেন, কুইন্টাল পর কুইন্টাল প্রস্তুত হয় ভক্তদের জন্য। অষ্টমীর দিন কুমারী পুজো অনুষ্ঠিত হয়, যা দূরদূরান্ত থেকে আগত দর্শকদের ভিড় জমায়। সপ্তমীর দিন ফুলপাতি ও নৃত্য পরিবেশন পাহাড়ি সংস্কৃতির বিশেষ রীতি। এই পুজোর সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলো দুর্গাদশমীর শোভাযাত্রা। মা দুর্গার প্রতিমা কাঁধে করে দার্জিলিং শহর প্রদক্ষিণ করা হয়। এবছর দীর্ঘ এক দশক পর এই রীতি আবার ফিরে এসেছে। পুজো কমিটির সেক্রেটারি ড. প্রতাপ আদিত্য গুহ জানালেন, প্রতিমাকে কাঁধে নিয়ে যাওয়া হবে দার্জিলিং রেলওয়ে স্টেশনে, যেখানে হিমালয়ান রেলওয়ের সহযোগিতায় ট্রয় ট্রেনে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে বাংলাখোলা পর্যন্ত, সেখানেই হবে বিসর্জন। শুধু রীতি-নীতি নয়, এবছর রয়েছে বিশেষ আকর্ষণও। নবমীর দিন শিলিগুড়ির খড়িবাড়ি থেকে আসছে ধামসা-মাদল দল, যারা পরিবেশনা মাতিয়ে তুলবে দর্শকদের। স্থানীয় বাঙালি পরিবার ছাড়াও নেপালি, তিব্বতি, লেপচা—সকলেই অংশ নেন। পর্যটকদের কাছেও এই পুজো হয়ে উঠেছে অন্যতম আকর্ষণ। ১১১ বছরের ইতিহাসে নৃপেন্দ্র নারায়ণ হিন্দু হলের পুজো প্রমাণ করে যে, সময় বদলেও ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং সামাজিক ঐক্যের মূল সুর অক্ষুণ্ণ থাকে।