সকাল তখন সাড়ে ন’টা। সুভাষপল্লীর নেতাজি উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠ তখনও নিরব, ক্লাসরুমগুলো আধখালি। কিন্তু একটি জানালার ফাঁক দিয়ে ভেসে আসছে দৃঢ় অথচ মমতাময়ী কণ্ঠ, “এই লাইনটার আসল অর্থ যদি ধরতে পারো, তবে পুরো গল্পটাই তোমার মনে চিরকাল থেকে যাবে।”
কণ্ঠস্বরের মালিক নরেশ চন্দ্র বর্মণ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সেই শিক্ষক, যিনি অবসরের পরও ছাত্রছাত্রীদের ছেড়ে যেতে পারেননি। মার্চ মাসে অবসর নেওয়ার পর অনেকেরই ধারণা ছিল, এবার নিশ্চয়ই বিশ্রাম, সংসার, শখপূরণের সময়। কিন্তু নরেশবাবুর কাছে শিক্ষাদান কেবল পেশা নয়, এক অমোঘ নেশা।

প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে তিনি স্কুলে আসেন, বিনা পারিশ্রমিকে পড়ান প্রান্তিক এলাকার ছাত্রছাত্রীদের, যাদের জন্য টিউশনের খরচ একেবারেই অসাধ্য। তিনি বলেন, “বাংলা শুধু মুখস্থের বিষয় নয়। বোঝার আনন্দ, ভাষার সৌন্দর্য, এসব যদি তাদের মনে ঢুকিয়ে দিতে পারি, তাতেই আমার জীবন ধন্য।”
যে পরিবারগুলির মাসিক আয়ে বই কেনাই কষ্টকর, সেখানে প্রাইভেট টিউশন বিলাসিতা ছাড়া কিছু নয়। সেই বাস্তবতার ভিড়েই নরেশবাবু যেন এক আশার প্রদীপ। তাঁর পড়ানো কেবল পরীক্ষার প্রস্তুতি নয়, ভাষার ভেতর দিয়ে চিনতে শেখান সমাজ, সংস্কৃতি, এমনকি জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি। ক্লাস শেষে ছাত্রছাত্রীদের মুখে যে হাসি ফুটে ওঠে, তা কোনও পারিশ্রমিকের চেয়ে মূল্যবান। তাদের কাছে তিনি শুধু ‘নরেশ স্যার’, যিনি যত্ন নিয়ে বোঝান, ধৈর্য নিয়ে শোনেন, আর পাশে দাঁড়ান নিঃস্বার্থভাবে।
অবসরের পরও ক্লাসরুমে দাঁড়িয়ে তিনি যেন প্রমাণ করে দিচ্ছেন, একজন প্রকৃত শিক্ষক কখনও অবসর নেন না। তাঁর মিশন শেষ হবে না যতদিন না তাঁর ছাত্রছাত্রীরা জ্ঞানের আলোয় নিজেদের পথ খুঁজে নিতে পারে।